একটি ছোট্ট গ্রাম, যার পাশ দিয়ে চলে গেছে লাল মাটির পথ। এই পথের একপাশে খোলা মাঠ, আরেকপাশে ছড়ানো-ছিটানো কিছু বাড়ি। তাদের মধ্যেই একটি পুরনো, লাল ইটের দোতলা বাড়ি, যেটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল তাল গাছ। অনেক দিনের পুরনো এই তাল গাছটি গ্রামবাসীর জন্য একটা আলাদা ভালোলাগা ও স্মৃতির আধার।
এই গাছটি ছোটবেলা থেকেই বাড়ির ছোট্ট মেয়ে লাবণীর খুব প্রিয়। লাবণীর ঠাকুরমা বলতেন, এই তাল গাছটি তাঁদের পূর্বপুরুষের হাতে লাগানো। ছোটবেলায় লাবণী প্রায়ই গাছটির তলায় বসে গল্প শুনতো—তার ঠাকুরমা বলতেন, এই গাছের নিচে অনেক যুগ ধরে গ্রামের বড় বড় পূজা-পার্বণ, উৎসব হয়েছে। তাল গাছটি যেন গ্রামের মানুষদের জীবনের অনেক স্মৃতি ও ইতিহাসের সাক্ষী।
তবে তাল গাছটির প্রতি গ্রামবাসীর ভালোবাসার আরেকটা বড় কারণ ছিল তার ফল। প্রতি বছরের মতো এবারও গ্রীষ্মের শুরুতে তাল গাছটি ফলতে শুরু করলো। বড় বড় কাঁচা তালের কাঁদি ঝুলছে ডালে। লাবণীর বাবা আর গ্রামের বয়স্ক লোকেরা বলতেন, “এবার তো মেলা তাল হবে।” লাবণী এই কথা শুনেই ভাবতে শুরু করলো, সে তালের শাঁস দিয়ে পিঠা বানাবে, মিষ্টি মিষ্টি তালের রস খাবে।
কিছুদিন পরে এক রাতে প্রচণ্ড ঝড় হয়। গ্রামের মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত, কারো ঘর ভেঙে যাচ্ছে, কারো ক্ষেতের ফসল নষ্ট হচ্ছে। ঝড় থেমে গেলে সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো, চারিদিকে নানান ক্ষয়ক্ষতি। কিন্তু তাদের সবার চোখ চলে গেল তাল গাছটির দিকে। লাবণী দৌড়ে যায় গাছের কাছে। তার চোখে পানি চলে আসে—ঝড়ে গাছটির একটি বড় ডাল ভেঙে পড়েছে মাটিতে, তালের কাঁদিগুলো ছড়িয়ে পড়েছে।
সবাই মিলে ভাঙা তালের কাঁদিগুলো নিয়ে গেলেন বাড়িতে। এদিকে লাবণী মন খারাপ করে ঘরে ফিরে গেল। তবে পরের দিন গ্রামের বৃদ্ধ লোকেরা বললেন, “গাছটি এখনো বেঁচে আছে। শুধু একটু সহানুভূতি আর যত্ন দিলে আবার আগের মতোই হয়ে যাবে।” তারা গাছটির চারপাশে বাঁশের খুঁটি লাগিয়ে দিলেন যেন গাছটি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
কয়েক মাস পর, বর্ষার পানি আর গ্রামের মানুষের যত্নে গাছটি আবার প্রাণ ফিরে পেলো। নতুন কচি পাতার মুকুল ফুটে উঠলো ডালে। গ্রামবাসীর চোখে যেন আনন্দের ঝিলিক ফিরে এলো। লাবণীও খুশি হয়ে বললো, “আমাদের তাল গাছটা আবার ভালো হয়ে গেছে!”
তালের গাছটি শুধু একটি গাছ নয়, এই গ্রামবাসীর বন্ধুর মতো। বছরের পর বছর তাদের ফল, ছায়া, আর ভালোবাসা দিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের মানুষ বুঝতে পেরেছে, প্রকৃতির যত্ন নিলে সে আবার নতুনভাবে বেঁচে ওঠে, আর তাদের জীবনে আনন্দ নিয়ে আসে।
গ্রামবাসী যেন সেই দিন থেকে আরও বেশি সচেতন হয়ে গেল। তারা প্রতিজ্ঞা করলো যে এই তাল গাছের মতো আর গাছগুলোও তারা রক্ষা করবে, যত্ন নেবে।
0 Comments